কুমিল্লার লাকসামের একটি ঘটনা

আমি নদী । গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে। ছোটবেলা থেকেই  ঢাকায় থাকি ।গ্রামে খুব একটা যাওয়া হয় না । বাবা অনেক জোর করে ৩ বছর আগে একবার ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে । ঢাকা থেকে লাকসাম কিন্তু বেশি দূরে না, অথচ পড়ালেখা আর ক্লাসের ঝামেলার কারণে এই অল্প দূরত্বই অনেক বেশি হয়ে দাঁড়ায় মাঝে মাঝে । যাই হোক, সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবা, মা, আমি আর আমার ছোট ভাই জয় মিলে দাদা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । বাবা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কুমিল্লায় আমরা যখন পৌঁছাই তখন বেলা প্রায় শেষের দিকে। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আমি আর আম্মু পাশের দোকান থেকে চা বিস্কিট কিনে খেতে লাগলাম আর বাবা গেলো নামাজ পড়তে । আমরা গাড়িতে বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় এক বুড়ো মতন লোক হঠাৎ কোত্থেকে যেন উদয় হলো । গাড়ির পিছনের সিটে ছিলাম আমরা । সামনের সিটে জয় ঘুমুচ্ছে । লোকটা এসে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো । চাহনি দেখে কেমন যেনো করে উঠলো বুকের ভেতর । শীতল চাহনি । অনেকটা মাছের মতো। আম্মু কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই লোকটি বলে উঠলো, অনেকদিন পরে গ্রামে আসলি তোরা। অনেকদিন পরে আসলি। সাবধানে থাকবি । সন্ধ্যার পর রাস্তা ভালো না। অনেক খারাপ জিনিস ঘুরে। অনেক সাবধান। অনেক সাবধান।
আমি আর আম্মু দুজনেই চা খাওয়া বাদ দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলাম লোকটার দিকে। আম্মুর আগে আমিই স্বাভাবিক হলাম। ঢাকা থাকার সুবাদে এইসব বাটপার লোক অনেক দেখেছি । কড়া গলায় বললাম, মাফ করেন । লোকটি তাচ্ছিল্লের হাসি দিয়ে বলল, আমি তোদের কাছে কিছু চাইতে আসিনি রে, তোদের সাবধান করতে এসেছি। তবে যাবার পথে পারলে পীরের মাজারে কিছু সিন্নি দিয়ে যাস। তোদের ভালো হবে। এই বলে লোকটা যেমন এসেছিলো তেমনি দ্রুত চলে গেলো । আম্মু খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, কি বলল রে লোকটা ? কথাবার্তা কেমন কেমন যেনো । আমি হেসে ব্যাপারটা নরমাল করার চেষ্টা করলাম। আম্মুকে বললাম, বাবাকে কিছু বলো না । অনেকদিন পর এসেছি আমরা, বাবা এসব শুনলে চিন্তায় পড়ে যাবে।

যাই হোক, বাবাকে কিছু জানানো হলো না। আমরা পুনরায় যাত্রা করলাম গন্তব্যের দিকে।

বাসা থেকে প্রায় ২০ মিনিটের দূরত্বে আবারো থামতে হলো। মাগরিবের নামাজের সময় প্রায় শেষের দিকে। বাবা মসজিদে চলে গেলেন। আমি আর আম্মু গাড়িতে বসে রইলাম। দুপাশেই সুন্দর ঢেউ খেলানো ধানের সারি দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস উঠছে খেতের উপর। সুন্দর পরিবেশ। দেখলেই শান্তি লাগে। একমনে তাকিয়ে আছি, এমন সময় সামনে কিছু একটা নড়ে উঠতে দেখলাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, আলোও প্রায় নিভু নিভু । চোখে ভুল দেখলাম নাকি বুঝতে পারলাম না । এবার দৃষ্টি স্থির করে তাকিয়ে রইলাম । এবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেটা । ধানের খেতের মাঝখানে একটা ছেঁড়া কাপর চোপড় পড়ান কাকতাড়ুয়া দাড় করিয়ে রেখেছিলো কেউ । আমার চোখের সামনে সেটি একটু নড়ে উঠলো । শুধু নড়ে উঠলো না, মনে হলো যেনো জায়গা পরিবর্তন করলো । হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি । মুখ দিয়ে বিস্ময়ের একটা আওয়াজ বেরিয়ে এলো। আম্মু লক্ষ করলো ব্যাপারটা । আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, কিরে কি হয়েছে ? আমি বললাম, ঐখানে একটা কাকতাড়ুয়া দেখতে পাচ্ছো? আম্মু চশমা চোখে লাগিয়ে বলল, হম দেখতে পাচ্ছি । তো কি হয়েছে ? আমি খানিকটা দ্বিধা মাখা কণ্ঠে বললাম, সেই কাকতাড়ুয়াটা খানিক আগে নড়েছে, হেঁটেছে, হেঁটে অন্য জায়গায় গিয়েছে ! আম্মু খানিকক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, তোকে এতবার নিষেধ করেছি আমার সাথে ফাজলামু করবি না, তারপরও ঠিক হলি না ?

আমি কিছুতেই আম্মুকে বুঝাতে পারলাম না ঘটনাটা । বাবা আসার পর আমরা পুনরায় বাড়ির পথে রওনা হলাম ।

বাড়ি থেকে খানিক সামনে একটা বড় পুকুরের মতো পড়ে । বাবার কাছে শুনেছিলাম পুকুরটা নাকি আমার বড় দাদা অর্থাৎ আমার বাবার দাদা কাটিয়েছিলেন । বিশাল গভীর পুকুর । সামনে অনেকগুলো নারিকেল গাছ । পাকা রাস্তা । মানুষ গাড়ি ঘোড়া কিছুই নেই । তাই বাবা মোটামুটি স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন । সামনের সিটে জয় ঘুম থেকে জেগে উঠে বসে আছে । গভীর মনোযোগে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে । হটাত বাবা আঁতকে উঠলেন । ঠিক সাথে সাথেই জয়ও চিৎকার করে উঠলো । কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাদের গাড়িটি গিয়ে বারি খেলো রাস্তার পাশের একটা নারিকেল গাছের সাথে ।

জয় তারস্বরে চিৎকার করছে । বাবা সাথে সাথে গাড়ির ভেতরের লাইট জালিয়ে দিলেন দেখার জন্য সব ঠিক আছে কিনা । আম্মুকে দেখে বুঝতে পারলাম অসম্ভব ভয় পেয়েছে । বাবা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গেলেন । বাইরে গিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কাকে যেনো খুঁজতে লাগলেন । আমি গাড়িতে থাকবো না নামবো ঠিক করতে পারছিলাম না । অবশেষে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম । বাবার পাশে চলে গেলাম, গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে বাবা ? গাড়ি ব্রেকে সমস্যা?

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে খানিকটা বিভ্রান্তের মতো বললেন, নারে মা । মনে হলো গাড়ির সামনে দিয়ে একটা মানুষ দৌড় মারল । স্পষ্ট দেখলাম গায়ে একটা ছেঁড়া কাপর পড়া । লোকটার গায়ে ধাক্কা দিবো না বলে গাড়ির নাক ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি । লোকটা মনে হয় বারি খেয়েছে গাড়ির সাথে ।

আমি, বাবা, আম্মু সবাই মিলে অনেক্ষন খুঁজলাম গাড়ির আসে পাশে। শেষে বাবা বলল বাড়িতে যাওয়া যাক । সেখান থেকে লোক নিয়ে এসে খোঁজা যাবে । সবাই একমত হলাম ।

বাসায় গিয়ে পৌঁছে যা শুনলাম তাতে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো ।

পুকুরের পাড়ে নাকি আজকাল অনেকেই এমন ঘটনার সম্মুখীন হয় । অনেকেই নাকি ছেঁড়া কাপড় চোপড় পড়া একটা মানুষ আকৃতির মূর্তিতে দেখে । কিন্তু গাড়ি, রিক্সা, বা মোটর সাইকেল থেকে নামার পর আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না । যদিও কেউ এখনো পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয় নি, তবে রাতে রাস্তা ঘাঁটে মানুষ চলাচল অনেক কমে গেছে।

(সংগৃহীত)

0 Comment "কুমিল্লার লাকসামের একটি ঘটনা"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন